স্পা সেন্টার এবং … ঈদের লম্বা ছুটি
স্পা সেন্টার এবং …
ঈদের লম্বা ছুটি শুরু হয়েছে , জরুরি সেবায় নিয়োজিত পেশাজীবী বাদে সকলেই টানা অবসর বিনোদনের সুযোগ পাবেন! অধিকাংশ মানুষই এতে আনন্দিত! তবে, এমনও কিছু মানুষ আছে যাদের জন্য এত লম্বা ছুটি -দুর্বিষহ!
যাদের জামিনের ফাইল কোর্টের সিরিয়ালে আছে, তাদের জন্য এত দীর্ঘ সময় আদালত বন্ধ থাকাটা প্রতীক্ষার- তবে এই প্রতীক্ষায় কোনরকম আনন্দ নেই, এক বুক দুশ্চিন্তা আর অসহ্য রকমের আকুতি নিয়ে তারা দিন গোনে ! আদালত কবে খুলবে?কোর্ট কবে বসবে?
ঈদের দুই দিন আগে সাত জন মেয়েকে কাশিমপুর কারাগারে নিয়ে আসা হলো! গুলশানের একটি অভিজাত স্পা সেন্টারে অভিযান চালিয়ে তাদের নাকি হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়েছে ! এই ধারায় আটক মেয়েরা সাধারণত হাজত থেকেই জামিনে চলে যায়! কোন এক অদৃশ্য ক্ষমতাশালী ব্যক্তির অংগুলি হেলনে তাদের কারাগার পর্যন্ত আসতেই হয়না ! কিন্তু, এবার ঈদের ছুটি শুরু হবার শেষ ক্ষণে কোন অজানা জটিলতায় তাদের জামিন না হওয়ায় কারাগারে আসতে হলো !
মহিলা কারাগারের সবাই কেস টেবিলে তাদের দেখতে ভিড় করেছে- তাদের চোখেমুখে উগ্র কৌতূহল! বন্দিনীদের ভাষায় এই মামলাকে বলে,•”চৌকি ভাংগা মামলা, বা খাট কাঁপানো মামলা!” এই মামলায় আটক মেয়েগুলোর ইস্ত্রি করা চুল, নেইল পলিশ লাগানো বড় বড় নখ, পোশাকের জাঁকজমক, চোখের চমক, দেহের ঠমক সাধারণ বন্দিনীদের ব্যপক আগ্রহের কারন ! সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তাদের পর্বত সম উঁচু হাই হিল স্যানডেলের প্রতি ! এজাতীয় স্যানডেল তো জেলখানায় সচরাচর দেখা যায়না !
এদের মধ্যে একজন মেয়েকে আমার রুমে পাঠানো হল! আমি তখন ৪০২ নং হাজতী ওয়ার্ডের পাহারা! নতুন বন্দিনীদের জন্য ঢালাও বিছানা করা হচ্ছে, সে এসেই অভিযোগের সুরে বলল, “আপু, আমি এইসব আজেবাজে মানুষের সাথে শুতে পারব না!
মেয়েটির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালাম! শ্যমলা গায়ের রং অথচ চুল সোনালি রং করা ! হাতের লোমগুলিও সোনালি ! পরনের টাইটসটা এতটাই টাইট যে তার দিকে তাকিয়ে কথা বললে সারাক্ষণ এই শংকা হয় যে কখন যেন বসতে গেলেই টাইটসটা ছিঁড়ে যায় দাঁত সামান্য উঁচু তারপরও মুখটাতে একটা আলগা লাবণ্য আছে !
মেয়েটির যেখানে শোবার ব্যাবসথা হয়েছে তার একপাশে একটা হেরাইন মামলার সত্তর বছরের বৃদ্ধা, ডায়াবেটিক গ্যাংগ্রিনে তার বাম পায়ের পাতা কাটা, সারাদিন পান চিবান আর থু করে পিক ফেলেন! আরেকপাশে কাওরানবাজার থেকে গাজা মামলায় আটক এক মেয়ে আর তার দুই বছরের বাচ্চা! বাচ্চাটি নির্বিচারে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেখানে সেখানে হিসু করছে !
আমি কঠিন কন্ঠে বললাম, যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন! আপনার ইচ্ছামত এখানে কিছু হবেনা! এটা জেলখানা, আপনার স্পা সেন্টার নয়!
মেয়েটি আহত হয়েছে মনে হলো! এরপর যতবার বিভিন্ন কারনে মেয়েটি কথা বলতে এসেছে আমি মুখ ফিরিয়ে রেখেছি! যারা সামান্য কিছু টাকার জন্য পরপুরুষের শরীর দলাই মলাই করে তাদের প্রতি নিজের অজান্তেই বিতৃষ্ণা আসে !
ঈদের দিন! পাহারা হিসেবে আমার মহা ব্যস্ততা! খাবার সবার মধ্যে সুষম বন্টন বিরাট চ্যলেনজ! সামান্য পরিমাণ মাংসের ঝোলের যদি এদিক ওদিক হয় তাহলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটবে ! আমি পোলাউ বাড়ছি…এমন সময় মেয়েটি এসে হাজির!
“ আপু, আমার সেন্ডেল চুরি হয়েছে”
আমি উত্তর না দিয়ে একমনে নিজের কাজ করতে থাকি! এই মামলায় যারা আসে তারা বেশিরভাগ সময়ই খালি পায়ে বের হয় - তাদের বাহারি হাইহিল চুরি হয়ে যায় !
মেয়েটি আবার গোয়ারের মতো বলে, আপনি শুনছেন না, আপনার রুম থেকে আমার সেন্ডেল চুরি হয়েছে!
“মসজিদেও জুতা চুরি হয়, আর এটা জেল ! যান, চোখের সামনে থেকে!” আমি খেকিয়ে উঠি!
“আমি জানি আপনি আমাকে পছন্দ করেন না! আমরা পতিতা ! বাইরের জগতে যাদের সাথে মিশতেন , মিটিং করতেন , কনফারেন্স করতেন, সন্মান করতেন তারাই স্পা সেন্টারে আমাদের কাছে আসে ! অথচ তাদের গায়ে পতিত লেখা সিলমোহর নেই ! তারা বউ বাচ্চা আর পুরো দুনিয়ার সামনে ভালোমানুষির মুখোশ পরে চলে! অথচ দোষী হই আমরা! “চিৎকার করে বলতে গিয়ে মেয়েটির গলা ভেঙ্গে এলো ! তারপরও বলে চলে,
“আমরা হাতেনাতে ধরা পরি, আর তাদের সসন্মানে ছেড়ে দেয়া হয়”
আমি থমকে যাই! আমার মুখে কথা সরেনা! তাই তো !
এই নিষিদ্ধ পণ্য বিক্রি করায় বিক্রেতার সাজা আছে, ক্রেতার কোন সাজা নেই !
অভিধানে পতিত বলে শব্দ নেই !!!!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন